(মা দিবস উপলক্ষে প্রবন্ধ) আমার দুঃখিনী মা : লেখক : হামিদুল আলম সখা

আমাদের গ্রামের বাড়ি তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার সরিষাবাড়ী থানায়। আমার দাদারা তিন ভাই। মহব্বত আলী সরকার,রুস্তম আলী সরকার,শেখ সোহরাব আলী। মূলতঃ বংশের নাম শেখ। তাদের বড় ভাই জমিদারের সরকারের কাজ করতো।সেই থেকে এদের বাড়ি কে সরকার বাড়ী বলে। আমার দাদার ছোট ভাই শেখ সোহরাব আলী মৃত্যু বরণ করে অকালে।রেখে যান একটি মাত্র মেয়ে।হাজেরা বেগম। আমার দাদা তার ভাতিজিকে নিজের কাছে রেখে দেন। আমার নানীর বয়স কম থাকায় অন্যত্র বিবাহ হয়ে যায়।দাদার সংসারে আমার মা কাজের মহিলাদের সাথে কাজ করতে করতে বড় হন। আমার দাদা তার নিজের ছেলে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করালেও আমার মাকে স্কুলে ভর্তি না করিয়ে মক্তবে ভর্তি করান।এদিকে দাদার বড় ছেলে আব্দুর রশীদ এন্ট্রাস(মেট্রিক)পাশ করেন। এবং পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকুরী নেয়।এসময় দাদা রুস্তম আলী সরকার তার বড় ছেলের সাথে ভাতিজির বিয়ে দিয়ে দেন। আমার আব্বা গোয়ালন্দ,পাকশী, শায়েস্তাগন্জ কাজ করে ময়মনসিংহ ষ্টেশনে বদলী হয়ে আসেন।
শুরু হয় আমার মায়ের সংসার।প্রথমে আমরা কৃষ্টপুর মজিদ চাচাদের বাসায় ভাড়া থাকি।১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহ রেলওয়ে কলোনিতে টি/১৮ নম্বর বাসায় উঠি।
সেই সময় জগনাথগন্জ ষ্টেশন থেকে একটি ট্রেন ময়মনসিংহে আসতো। ট্রেনটির নাম ছিল জিএম ট্রেন। ময়মনসিংহে পৌছতো ১.৩০ মিনিটে।

আমার দুঃখিনী মা-২

পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহ জেলায় কোর্ট কাচারী, হাসপাতাল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বলে সরিষাবাড়ী থেকে কেউ মামলার কাজে আসতো,কেউবা চিকিৎসার কাজে আসতো আবার কেউবা লেখাপড়া বা চাকরির খোঁজে আসতো।আর জিএম ট্রেনে সরিষাবাড়ী থেকে আমাদের আত্মীয়স্বজন, এলাকার লোকজন সবাই ময়মনসিংহে আসতো।ষ্টেশনে নেমে সোজা আমাদের বাসায়।প্ল্যাটফরম থেকে আমাদের বাসা তিন মিনিটের পথ।সবাই দল বেধে আমাদের বাসায় আসতো নিজের বাসা মনে করেই।বাসায় এসে আমার আম্মাকে কেউ বুবু,কেউ চাচি,কেউ মামী,কেউ খালা বলে ডাকতো। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধূয়ে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে যেতো।কেউ কেউ আম্মাকে সাহায্য করতো।প্রায় প্রতিদিনই ৫-৭ জন থাকতোই।আম্মা হাসিমুখে তার আত্মীয়দের আবার পরিবেশন করতেন।আব্বা সব সময় বলতেন এলাকার কেউ যেনো না খেয়ে না যায়।আব্বা আরো বলতেন মানুষের রিজিক যেখানে সে সেখানে খাবে।
এভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলেছে।এই আপ্যায়ন করতে গিয়ে কোন কোন দিন লবন দিয়ে ভাত খেয়ে উঠতো।আমরা কোনদিন এটি জানতে পারিনি। একদিন আমার চোখেই ধরা পড়ে।আমি রান্না ঘরে গিয়েছি লবন আনতে। কাঁচা আম কেটে খাবো।দেখি আম্মা ভাত খাচ্ছে লবন দিয়ে।
মায়েরা অনেক কস্টের কথা মাটি। চাপা দিয়ে রাখে।

আমার দুঃখিনী মা-৩

আমার ছোট আরেক ভাই। আমাদের চার জনের সংসার । ইচ্ছে করলে আব্বা আমাদেরকে নিয়ে ভালো ভাবে চলতে পারতেন। কিন্তু আমার আব্বা তা করেননি।তিনি নিজের ভাই বোন,ভাতিজা,ভাগ্নি সব্বাইকে নিয়ে সংসার সাজিয়েছেন।আব্বা রেলওয়ে তে যে চাকরি করতেন তাতে অবশ্যই কস্ট হতো।আর এ কস্টের বেশীরভাগ আমার আম্মাকে বহন করতে হতো। আমার আব্বা আম্মা সারা জীবন তাদের জন্য করেছেন।তারা কি মনে রেখেছেন?যদিও আমার আমরা কখনো কোনদিন প্রতিদান চান নি।
আরেক দিনের কথা বলি।
রাত দশটার ভিতর আমাদের রাতের খাবার হয়ে যায়।আম্মা সবার শেষে খেতেন।আমি আমার চাচাতো ভাই (যাকে ছোটবেলা থেকেই আব্বা আমাদের বাসা নিয়ে এসেছিলেন।), আমার ছোট ভাই,ছোট কাকা রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছি। সবকিছু গুছিয়ে আম্মা খেতে যাবেন এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।আমি দরজা খুললাম। বর্তমানে তিনি প্রয়াত।তিনি সমাজে অনেক বড়মাপের মানুষ হয়েছিলেন পরবর্তীতে।আজ তার নামটা নাই বললাম।আম্মার খাবারটা তাকে খাওয়ালেন। এবং থাকার ব্যবস্থা করলেন। আমার আম্মা একটু খানি চিড়া খেয়ে রাত কাটিয়ে দিলেন।এভাবে আমার আম্মা তার সংসার জীবন কাটিয়েছেন।

আমার দুঃখিনী মা-৪

মা সন্তানের প্রাণ আবার সন্তানও মায়ের প্রাণ।একে অপরের পরিপূরক।সন্তান হলো নাড়ি কাটা ধন।তবে ব্যতিক্রমও আছে। অনেক সন্তান মাকে অনেক কস্ট দিয়ে থাকে।তারপরও মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায় না।হাসি মুখে সব কস্ট মেনে নেয়।আমরা দু’ভাই।আমার ছোট স্বপন। আমাদের জন্য আমার মা কখনো কস্ট পায়নি। আমার মনে পড়ে আমরা সবসময় আব্বাকে ভয় পেতাম।আমরা সবসময় আম্মার আঁচলের নীচে থাকতাম।ছোট বেলায় আমি আমার মায়ের আঁচলে যখন মুখ লুকাতাম তখন একটা গন্ধ পেতাম।এটাই বোধ হয় মায়ের গন্ধ।কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ী থেকে নানা বাড়ি চাপারকোনা গ্রামে।এটা মূলতঃ নানীদের বাড়ি। রাজাকারের উৎপাতের কারণে দাদা এক কাকডাকা ভোরে গরুর গাড়ী করে নানা বাড়ি পাঠালেন।দাদা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রাজাকার রা একটি তালিকা তৈরি করেছিল।যাদের বয়স ১০-১১। মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘ হয় তবে এসব বয়সের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবে।তাই তাদের তালিকা করে তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়।আমরা নানা বাড়ি গিয়ে খুবই আনন্দ পাই।এক.চাপারকোনা হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।সেটা পরিচালনা করেন আমার নানারা।তারা চার ভাই বিরাট গৃহস্ত। একদিন মামাতো ভাই দের সাথে ডাংগুটি খেলতে গিয়ে মামাতো ভাই হেলাল এর কপাল ফাটিয়ে দেই। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল।তা দেখে আমি দৌড়।নানাদের বাগানবাড়িতে গিয়ে পালাই। বিকেলবেলা আমাকে সবাই ধরে নিয়ে আসে।আমি কাদছিলাম। বাড়িতে আসার পর আমার মা আমাকে ধরে কাঁদছিল।আর বলছিল ,এই তোরা আমার ছেলের জন্য ভাত নি। কোথায় আমার শাস্তি হবে সেখানে মাংস দিয়ে আমাকে ভাত খাওয়ালো।এই হলো মা।আমার মাকে নানা বাড়ীর সবাই খুব সমীহ করতো।
স্বাধীন হবার পর একজন মুরুব্বী আমাদের বাসায় প্রতি সপ্তাহে আসতো। গ্রামের মানুষ তাকে মামলাবাজ বলতো। ময়মনসিংহ জজ কোর্টে তার মামলা থাকতো। আমার মা উনাকে চাচা বলে ডাকতেন।উনার জন্যও আমার মাকে না খেয়ে থাকতে হতো।

আমার দুঃখিনী মা-৫

আমার মাকে নিয়ে অনেক লেখা যায় ।অবশ্য পৃথিবীর সমস্ত মা দুঃখিনী হয়ে থাকেন কম বেশী।আমি যখন খুলনায় থাকতাম তখন আমরা বছরে দুই একবার আমার কাছে যেতেন।আমি মাকে তার মাস আমার কাছে রেখে দিতাম।তার দুশ্চিন্তা ছিল আমার ছোট ভাই স্বপনকে নিয়ে।আমি মাকে বলতাম আপনার কোন কাজ নাই।নামাজ পড়বেন,খাবেন থাকবেন আর সূচনা ও স্পর্শ এর সাথে খেলবেন।তাই করতো।আমি অফিস থেকে আসলে বিচার দিত তোর বউ আমাকে কাজ করতে দেয় না।আমি কাজ ছাড়া থাকতে পারি?
আমি বলতাম ঠিক আছে টুকটাক কুটা বাছার কাজ করবেন। একদিন রাতে খেতে বসে আমার স্ত্রী জানালো আম্মা মাছ সম্পূর্ণ খায় না।আমি তোমাকে বলিনি ।সব সময় মাছ ভেঙ্গে অর্ধেক খায়।আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,বাবারে খেতে পারি না। আমার চোখে জল এসে গেলো।সাড়া জীবন মাছ ,মাংস খেতে পারেনি।মাছ কখনো খেলেও অর্ধেক খেতেন। সেই যে না খাওয়ার অভ্যাস-সেটা রয়ে গেছে। আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতো খেতে পারি না। আমার মা দুধ কলা খেতে পচ্ছন্দ করতেন।
আমার কস্ট আমি ঢাকায় আসার পর মায়ের সেবা করতে পারলাম না।
একটি গানের কথা কেবলি আমার মনে পড়ে, “মায়ের মতো আপন কেহ নাই,মা জননী নাইরে যাহার এ ভূবনে তাহার কেহ নাই রে—-।”
লেখক: হামিদুল আলম সখা
সদস্য, বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
সহ সভাপতি, ঢাকা মহানগর বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
সাব এডিটর, সাপ্তাহিক শীর্ষ খবর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *